
আজ অপুর পরীক্ষা। তাই সে তাড়াহুড়ো করে স্কুলে যাচ্ছে। আজ অপু একটু বেশিই খুশি। কারণ, পরীক্ষার সময় সে নিজের মগজকে যাচাই করার সুযোগ পায়। তার ওপর আজকের আনন্দের আরও একটা বড় কারণ হলো, সে নতুন একটি কলম কিনেছে। কলমটা দামি, আবার কালি ভরে বারবার লেখা যায়। এই কলমকে ঘিরেই একটি ছোট কম্পানিও দাঁড়িয়ে গেছে, যাদের কাজ এই কলমগুলোর জন্য কালি সরবরাহ করা।
আজ প্রথম পরীক্ষা। অপু জানে, সে যতই পড়ুক না কেনো তার ফলাফল ভালো হবে না। তবুও সে চেষ্টা করেই যায়। পরীক্ষা শুরু হলো। অপুর হাত যেন থামতেই চাইছে না। লিখছে আর লিখছে। সব পড়াগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তার মনে হচ্ছে, আগের যে কোনো পরীক্ষার চেয়ে আজ অনেক বেশি ভালো পরীক্ষা দিচ্ছে। ক্লাসে দায়িত্বে থাকা শিক্ষকও তার একটানা লেখা দেখে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। সন্দেহবশত তাকে পরীক্ষা করলেন যে, কোনো নকল-টকল আছে কি না। কিন্তু কিছুই পেলেন না।
আজ ২য় পরীক্ষা...
আজ ৩য় পরীক্ষা...
আজ পরীক্ষার শেষ দিন। অন্যান্য পরীক্ষার সময় পরীক্ষার শেষ দিন সব বন্ধুরা মিলে সাধারণত আড্ডা দিতো। কিন্তু আজ আগের মতো কারও সাথে কথা না বলে দ্রুত বাড়ি ফিরল। বাড়িতে এসে একসময় নিজের টেবিলে বসে ব্যাগ থেকে সেই নতুন কলমটি বের করলো। এরপর কাটা কম্পাস দিয়ে কলমের গায়ে নিজের নাম লিখে দিল। কলমটা এমনিতেই সুন্দর ছিল, নাম লিখে যেন আরও সুন্দর হয়ে গেল। মনে হলো, এটা অপু গ্রুপের একটি পন্য। অপুর মনে হতে লাগলো, এটা তার ভাগ্যের কলম। কারণ, এটা দিয়ে লিখতে গেলেই সবকিছু তার মনে ভেসে ওঠে। মজার একটা ব্যপার।
আজ রেজাল্টের দিন। অপুর ভয়ে হাত-পা কাঁপছিল। আগেরবারের মতো খারাপ হবে নাকি? বরাবরই তার রেজাল্ট যথেষ্টই খারাপ হয়। কিন্তু ফল হাতে পেয়ে সে দেখে, এবার ক্লাসে চতুর্থ হয়ে গেছে! এর আগে এত ভালো ফলাফল সে কখনই করতে পারেনি। বন্ধুরা তাকে অভিনন্দন জানাল। যে শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাকে টুকটাক চিনতো, তাঁরাও বেশ খুশি হলেন। বাড়িতেও আনন্দের বন্যা। যার থেকে কখনই কিছু আশা করেনি, তার থেকে এমন ফল পেয়ে খুশি না হয়ে উপায় আছে? তবে, সবাই এবার তাকে প্রথম হওয়ার জন্যে মনোযোগী হতে বললো।
বছর ঘুরে যায়। অপুর পড়াশোনা ও ভালো ফলাফলের কারণে সে হয়ে ওঠে সকলের কাছে ধীরে ধীরে পরিচিত হতে শুরু করে। ভদ্রতার কারণে আগে থেকেই তাকে টুকটাক সবাই পছন্দ করত। এখন রেজাল্টের কারণে ব্যাপারটা আরও বেড়ে গেলো। দিন দিন তার পড়াশুনাও বাড়তে শুরু করলো। হঠাৎ করেই যেনো তার পড়ার প্রতি আগ্রহ অনেকখানি বেড়ে গেছে। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়ে গেছে, বন্ধুরা সমস্যায় পড়লে তার কাছে আসে, শিক্ষকরা তাকে চোখের মণির মতো দেখেন।
অবশেষে স্কুলজীবন শেষ করে কলেজে ভর্তি হলো। ফলাফল যথেষ্ঠই ভালো। সকাল বেলা অনেক পরিপাটি হয়ে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। সব ঠিকঠাক গুছিয়ে নেয়ার পর কলেজে যাওয়ার আগের হঠাৎ লক্ষ করলো, তার এত প্রিয় কলমটি ব্যাগে নেই! সময় বেশি হাতে না থাকায় সেই রকম মন খারাপ অবস্থা নিয়েই কলেজে গেল, কিন্তু কোনোভাবেই পড়াতে মন বসাতে পারল না। ওই দিন বাসায় ফিরে পুরো বারি তন্ন তন্ন করে খুঁজল। এমন অনেক যায়গাতেও খুঁজল যেখানে সেটা থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই। একসময় খুঁজতে খুঁজতে হাল ছেড়ে দিল।
হঠাৎ তার চোখে পড়ল টেবিলের ওপর। না, সেখানে কলমটি নেই। একটা অদ্ভুত খাতা। খাতাটি একটু ভিন্নরকম, পাতলা কাগজে তৈরি, ভেতরে হাতের মতো আঁকা নকশা। অনেক আগে একসময় সে নিজেই এটা বানিয়েছিলো, তবে মাঝে সেখানে কিছুই ছিলো না। আজ এটার মাঝখানে লেখা ছিল,
"আর দেখা হবে না, হবে না লেখা তোমার সাথে।
মনে পড়বে আমার তোমায়, খুঁজবে অনেক,
পাবেনা কখনো সেই অমূল্য রতন।
মান রেখো, ছাড়ো না হাল, ছাড়ো না ফল,
কখনো ভুলো না আমায়, ভুলো না মাহেন্দ্রক্ষণ।
সাথে আছি, সাথে থাকব সর্বক্ষণ,
আমায় পাবে তুমি পড়ার ভিতর।"
অপুর কাছে মনে হলো এটা যেন বিদায়বাণী। তার মনে হলো, কলমটি হারিয়ে যাওয়ার আগে এ খাতায় নিজের ছাপ রেখে গেছে। তবে সে এটাও টের পেল, হয়তো অবচেতনভাবে সেই ছন্দগুলো সে নিজেই লিখেছে! হয়তো গতকালই...?
সময় চলে যায়। কলমের অভাব পূরণ করতে না পারলেও বইয়ের ভেতরেই অপু খুঁজে নেয় শান্তি। অনেকটা যেনো সেই ছন্দের মতোই...
চল্লিশ বছর কেটে গেছে। এখন অপু বৃদ্ধ। তবু সেই কলম আর সেই খাতার কথা এখনও পুরোপুরি মুছে যায়ন। চোখ বন্ধ করলে এখনো তার মনে হয়—কলমটা যেন রহস্যে ঘেরা, জীবনের বাঁকে বাঁকে তাকে পথ দেখানো এক নীরব সঙ্গী......
গল্পের তথ্য
গল্পের নাম : কলম
ধরণ : মনস্তাত্ত্বিক
সংগ্রহ : অপু সিরিজ ছোটগল্প
লেখক : নাঈমুর রহমান
বি:দ্র:
এই গল্পগুলো ২০১৭ সালের দিকে লেখা। তাই, এখানে তথ্যগত কোনো ভুল থাকলে আশা করি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।