প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে আমাদের সাথে টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত হতে পারেন (Only Boys) Join Now!

ভিডিও গেম পাইরেসি সমাচার

ভিডিও গেম পাইরেসি সমাচার

চ্ছা, সত্যি করে বলেন তো, আপনার জীবনের প্রথম Minecraft কি Microsoft Store থেকে ডাউনলোড করা ছিল? নাকি প্রথম GTA V খেলেছিলেন Steam থেকে কিনে? আমার জানা মতে, আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই কোনো একটা X Y Z লঞ্চার ব্যবহার করি, টরেন্টের নাম শুনলেই একটা আলাদা ভালোবাসা কাজ করে। আমি জানি, আমি জানি, আমি আপনার ডেস্কটপটা দেখতেই পাচ্ছি। লুকিয়ে লাভ নেই।

তাহলে, চলুন এটা মেনে নিই: পাইরেসি আমাদের জীবনে একটা খুব বাস্তব জিনিস। আমরা সবাই কোনো না কোনো সময় কিছু একটা পাইরেট করেছি। একটা গেম হোক, একটা সফটওয়্যার, বা কোনো জনপ্রিয় টিভি শো। আমাদের পছন্দের সিরিজের শেষ সিজনটা কোথায় দেখেছি, সেই কথা তো আর বললামই না।

কিন্তু এই জিনিসগুলো ডাউনলোড করার সময় কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আসলে পুরো সিস্টেমটা কীভাবে কাজ করে? আপনি যে ফাইলটা ডাউনলোড করছেন, সেটা আসে কোথা থেকে? আর কেই বা এসব আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়? এটা আক্ষরিক অর্থেই একটা ডিজিটাল চোরাচালানের মতো, শুধু আসল অবৈধ জিনিসগুলো ছাড়া। আজ আমি সব ধরনের পাইরেসি নিয়ে বলবো না, মূলত গেম পাইরেসিতেই মনোযোগ দেবো, কিন্তু সব ক্ষেত্রেই প্রক্রিয়াটা প্রায় একই রকম। তাহলে চলুন, জেনে নেওয়া যাক গেম পাইরেসি আসলে কীভাবে কাজ করে।
তো, সবকিছুর আগে, একটা গেমের কথা ধরি। যেকোনো একটা বড়, ট্রিপল এ গেম। ধরেন, আমি একজন গেম ডেভেলপার আর আমার নতুন গেম ‘Name One Game’ মার্কেটে আসছে। অবশ্যই আমি চাইবো যে মানুষ আমার গেমটা টাকা দিয়ে কিনে খেলুক, যাতে আমার আর আমার স্টুডিওর পকেটে কিছু টাকা আসে। আমি কখনোই চাইবো না কেউ আমার গেমটা 'হ্যাক' করে ফেলুক।

কিন্তু ইন্টারনেটের পাবলিক তো আর বসে থাকবে না। তারা তো চেষ্টা করবেই। এই ধরনের চেষ্টা থেকে নিজের গেমকে বাঁচানোর জন্য, আমি আমার গেমের উপর একটা লক সেট করবো। না, সাধারণ তালা চাবি না, একটা ডিজিটাল লক। এই ডিজিটাল লকটা শুধু তাদের জন্যই খুলবে যারা গেমটা বৈধভাবে কিনেছে। এই ডিজিটাল তালাকেই বলা হয় DRM, বা Digital Rights Management। এটা এমন একটা প্রযুক্তি যা নিয়ন্ত্রণ করে একটা গেম কীভাবে অ্যাক্সেস করা যাবে, ব্যবহার করা যাবে, এবং বিতরণ করা যাবে।

এখনকার সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ডিআরএম গুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে Steamworks, যা Steam এর নিজেদের বানানো। Steam এ যত পেইড গেমস দেখেন, তার বেশিরভাগই এই ডিআরএম ব্যবহার করে। কিন্তু বড় বড় গেমস, যেমন GTA V, শুধু Steam এর ডিআরএম ব্যবহার করে না। তারা এর উপর আরও একটা সুরক্ষার স্তর হিসেবে তাদের নিজেদের লঞ্চারও ব্যবহার করে, যেখানে আরও একটা ডিআরএম থাকে। এত সুরক্ষার পরেও, আপনি GTA V এর পাইরেটেড ভার্সন খুব সুন্দর মতো পেয়ে যাবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে?

এখানেই প্রবেশ করে পাইরেটরা। তাদের প্রথম কাজ হচ্ছে এই ডিজিটাল তালা ভাঙা। আর এই কাজটা করার জন্য পাইরেসি ইকোসিস্টেমে প্রথমে আসে ‘ক্র্যাকিং গ্রুপস’, যাদেরকে ‘সিন গ্রুপস’ ও বলা হয়। এরা হচ্ছে কিছু অত্যন্ত দক্ষ, আন্ডারগ্রাউন্ড টিম যারা গেমের ডিআরএম ক্র্যাক করার কাজ করে।
জিনিসটা কীভাবে হয়? সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হচ্ছে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং। আচ্ছা, আমি জানি, এটা খুব বেশি টেকনিক্যাল শোনাচ্ছে। আমি মাইনক্রাফটের উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি। মনে করুন, একটা গেমের .exe ফাইল হচ্ছে একটা খুব জটিল রেডস্টোন মেকানিজম, যা একটা লক করা চেস্টের মধ্যে আছে। রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে চেস্টটা খুলে, ভেতরের সব রেডস্টোন ওয়্যারিং, রিপিটার, কম্পারেটর, সব কিছু বুঝে ফেলা যে কোনটা কীভাবে কাজ করছে। আর ডি বাগার টুলগুলো, যেমন x64 DBG, হচ্ছে মাইনক্রাফটের স্পেশাল মোডের মতো, যা আপনাকে ওই চেস্টের ভেতরের সব লুকানো রেডস্টোন ব্লকও দেখতে সাহায্য করবে। আপনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে ওই নির্দিষ্ট রেডস্টোন সুইচটা খুঁজে বের করা যা গেমের দরজা বন্ধ রাখে। ওই সুইচটা পেয়ে গেলে, আপনি ওটাকে বাইপাস করে নিজের একটা সুইচ বসিয়ে দেবেন। ব্যাস, হয়ে গেল। যে দরজা আগে শুধু অফিশিয়াল কি দিয়ে খুলতো, সেটা এখন আপনার নিয়ন্ত্রণে।

সত্যি বলতে, এটা আমার কাছে খুব আশ্চর্যজনক লেগেছিল যে এই ক্র্যাকিং গ্রুপগুলো আক্ষরিক অর্থেই একের অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে যে কে আগে নতুন গেম ক্র্যাক করবে। Codex, Reloaded, CPY, এরকম অনেক গ্রুপ আছে। এমনকি, Reloaded গ্রুপের এত দাপট ছিল যে তারা কিছু গেমস অফিশিয়াল রিলিজ হওয়ার আগেই তার ক্র্যাকড ভার্সন বের করে দিত! ভাবতে পারেন? এর মানে হচ্ছে, তাদের যোগাযোগ ইন্ডাস্ট্রি ইনসাইডারদের সাথেও আছে যারা তাদের কে রিলিজের আগেই ফাইলস দিয়ে দেয়। গেম পাবলিশারদের হতাশার কথা একবার কল্পনা করুন। তারা ট্রেইলার দিচ্ছে, রিলিজের তারিখ ঘোষণা করছে, আর তার দুই ঘণ্টা আগেই কোনো একটা অপরিচিত ওয়েবসাইটে তাদের গেমটা ইতোমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে।
ক্র্যাকিং এর পর, পাইরেসির দ্বিতীয় ধাপে আসে ‘রিপ্যাকার্স’। ক্র্যাকিং গ্রুপ যারা গেমটা ক্র্যাক করে, তারা ফাইলগুলোকে খুব অগোছালো ভাবে রেখে দেয়। রিপ্যাকার্সরা সেই অগোছালো ফাইলগুলোকে একসাথে করে, অর্গানাইজ করে, কম্প্রেস করে একটা রেডি টু ইন্সটল প্যাকেজ বানায়। মূলত, আমরা যাদেরকে চিনি, যেমন FitGirl Repacks, এরা হচ্ছে সেই মধ্যস্বত্বভোগী। তাদের ছাড়া, ক্র্যাকিং গ্রুপদের কাজ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো টাই কঠিন হয়ে যেত।

কিন্তু মনে রাখতে হবে, সব রিপ্যাকার্সরা কিন্তু ভালো মানুষ না। অনেকেই আছে যারা এই সুযোগে আপনার ডাউনলোড ফাইলের সাথে একটা ভাইরাস বা ক্রিপ্টো মাইনার ইন্সটল করে দেয়। এইজন্য অনেক সময় দেখা যায় যারা খুব বেশি পাইরেসি করে, তাদের পিসির জিপিইউ আর সিপিইউ তাপমাত্রা সবসময় বেশি থাকে, এমনকি যখন পিসিতে বড় কোনো কাজও হচ্ছে না। এর কারণ, তাদের পিসিটা ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা ক্রিপ্টো মাইনিং মেশিন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
তৃতীয় ধাপে আসে ওয়েবসাইট এবং পোর্টাল। এগুলো হচ্ছে সেই জায়গা যেখান থেকে আমরা, অর্থাৎ শেষ ভোক্তারা, ফাইলগুলো ডাউনলোড করি। The Pirate Bay, 1337x, এরকম হাজার হাজার সাইট আছে। কিন্তু এই ওয়েবসাইটগুলোও খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে এত বিরক্তিকর বিজ্ঞাপন থাকে যা পুরো ইন্টারনেটে আর কোথাও পাবেন না। 'Riya is 4 km near you' টাইপের বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে জীবন শেষ। এই বিজ্ঞাপনগুলোই অনেক সময় ক্লিকের মাধ্যমে আপনার পিসিতে ভাইরাস এনে দিতে পারে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যারা এত কষ্ট করে এই কাজগুলো করছে, তারা আসলে কি পায়? সরাসরি উত্তর হলো টাকা। কিন্তু কীভাবে? যেখানে ডাউনলোডার তো কোনো টাকা দিচ্ছে না। সবচেয়ে সাধারণ উপায় হচ্ছে বিজ্ঞাপন থেকে আয় করা, আর আরেকটা হচ্ছে ওই যে বললাম, ক্রিপ্টো মাইনিং বা ম্যালওয়্যার ইন্সটল করে দেওয়া।

তবে, সবাই যে শুধু টাকার জন্য পাইরেসি করে, তা কিন্তু না। ইন্টারনেটে এরকম অনেক মানুষ আছে যারা পাইরেসিকে একটা প্রতিবাদ হিসেবে দেখে। তাদের একটা জনপ্রিয় কথা হচ্ছে, ‘If buying is not owning, then pirating is not stealing.’ কথাটা কেন বলে, সেটা একটু ব্যাখ্যা করি। আপনি যখন Steam থেকে একটা গেম কেনেন, আপনি আসলে গেমটার মালিক হয়ে যান না। আপনি শুধু সেটা খেলার জন্য একটা লাইসেন্স পান, যা Steam যেকোনো সময় আপনার থেকে কেড়ে নিতে পারে। ফিজিক্যাল গেম ডিস্কের মতো এটা আপনার স্থায়ী সম্পদ না। এই কারণেই, অনেক পাইরেটরা মনে করে তারা কোনো চুরি করছে না, বরং একটা সীমাবদ্ধ সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়ছে। আমি এখানে বলতে আসিনি পাইরেসি ভালো না খারাপ, সেটা আপনার ব্যক্তিগত মতামত।
সবশেষে, একটা দারুণ কাহিনী দিয়ে শেষ করি। আপনি কি কখনো কোনো গেম নির্মাতার মুখে শুনেছেন যে, ‘আমার গেমটা পাইরেট করে ফেলো’? সম্ভবত না। কিন্তু Minecraft এর নির্মাতা, Notch, কে যখন একজন বলেছিল যে তার Minecraft কেনার মতো টাকা নেই কিন্তু খেলতে খুব ইচ্ছা, Notch তাকে বলেছিল, 'পাইরেট করে নাও'। আর যদি গেমটা ভালো লাগে, তবে ভবিষ্যতে যখন আপনার টাকা হবে, তখন কিনে নিও। কী দারুণ একজন মানুষ!

সবশেষে, পাইরেসি আর গেম ডেভেলপারদের এই ইঁদুর-বিড়াল খেলা কিন্তু চলছেই। একটা ডিআরএম ক্র্যাক হলে আরেকটা নতুন ডিআরএম আসে, আর সেই নতুন ডিআরএম ভাঙার জন্য আবার নতুন ক্র্যাকিং গ্রুপ তৈরি হয়। এটা আসলে প্রযুক্তির একটা অবিরাম দৌড়। এই পুরো চক্রের মাঝখানে আমাদের মতো সাধারণ গেমাররা দাঁড়িয়ে আছি। পাইরেসি ভালো না খারাপ - এই বিতর্কের কোনো সহজ উত্তর নেই।


Written by
Naimur Rahaman
FrostFoe
Curious Mind | Passionate About Tech & Creativity | Lifelong Learner

মন্তব্য করুন

টেলিগ্রাম ভিত্তিক কমেন্ট সিস্টেম

إرسال تعليق

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.