যারা টেকনোলজি নিয়ে টুকটাক ঘাটাঘাটি করি, তারা প্রায় সকলেই
“ওপেন সোর্স” শব্দটির সাথে পরিচিত। আজ আমরা জানবো ওপেন সোর্স কী, এর সুবিধা ও অসুবিধা কী কী, এবং কোথায় সহজে
ফ্রি ও ওপেন সোর্স সফটওয়্যার (FOSS) বা অ্যাপ পাওয়া যায়।
ওপেন সোর্স কী?
ওপেন সোর্স সফটওয়্যার এমন একটি সফটওয়্যার, যার সোর্স কোড সবার জন্য উন্মুক্ত। অর্থাৎ, এটি কীভাবে তৈরি হয়েছে, তা যে কেউ দেখতে, বিশ্লেষণ করতে এবং যে কেউ প্রয়োজন অনুযায়ী উন্নত করতে পারবে। চাইলে নিজের ব্যবহারের জন্য কাস্টমাইজ করেও নেওয়া সম্ভব!
ধরুন, আপনি কোথাও এক কাপ চা খেলেন, সেটা ভালোও লাগলো। কিন্তু সেটা কিভাবে বানানো তা আপনার জানা নেই। এইটা সাধারণ বা ক্লোজড সোর্স সফটওয়্যার।
অন্যদিকে, ধরুন আপনাকে চায়ের সাথে তার রেসিপি দেওয়া হলো। এক্ষেত্রে আপনার কাছে সেই রেসিপি অনুসরণ করে সেই একই স্বাদের চা বানানোর সুযোগ আছে। এইটিই ওপেন সোর্স সফটওয়্যার।
কিছু উদাহরণ
- বেশিরভাগ আমরা সবাই অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার করে থাকি। এই অ্যান্ড্রয়েড ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম। এই সোর্স কোডের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন কম্পানি, যেমন Samsung, Mi ইত্যাদি কম্পানি OneUI বা Hyper OS এর মতো UI ডেভেলপ করেছে। (সোর্স কোড)
- বহুল ব্যবহৃত ব্রাউজার, গুগল ক্রোম মূলত ক্রোমিয়াম প্রজেক্টের উপর ভিত্তি করে বানানো। এই ক্রোমিয়াম ওপেন সোর্স। Microsoft Edge, Brave এর মতো জনপ্রিয় ব্রাউজারগুলোও ক্রোমিয়ামের উপর ভিত্তি করে বানানো। (সোর্স কোড) এছাড়া আর এক জনপ্রিয় ব্রাউজার, মজিলা ফায়ারফক্সও ওপেন সোর্স ব্রাউজার। (সোর্স কোড)
- যদিও ম্যাক্সিমাম সবাই উইন্ডোজ ব্যবহার করে যা ক্লোজড সোর্স। এর ওপেন সোর্স অল্টারনেটিভ লিনাক্স। (সোর্স কোড) এটাও এখন বেশ জনপ্রিয়। মজার বিষয়, অ্যান্ড্রয়েডের কার্নেল হল লিনাক্সের কার্নেল। সহজ ভাষায় বলা যায়, অ্যান্ড্রয়েডের পেছনেও লিনাক্সের ভূমিকা আছে।
- এছাড়া বহুল ব্যবহৃত ভিডিও অডিও প্লেয়ার VLC Media Player (সোর্স কোড), জনপ্রিয় CMS WordPress (সোর্স কোড) - ও ওপেন সোর্স সফটওয়্যার।
সুবিধা
● সাধারণত, ওপেন সোর্স সফটওয়্যারগুলো
ফ্রি ও লাইটওয়েট হয়ে থাকে। অর্থাৎ, কোনো টাকা ছাড়াই সফটওয়্যারগুলো ডাউনলোড, ইনস্টল ও ব্যবহার করা যায়। এমনকি নিম্ন কনফিগারেশনের ডিভাইসেও ভালো পারফর্ম করে। (তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো কিছু ফিচারের জন্য চার্জ করে। আবার, লাইটওয়েট হওয়ার পাশাপাশি কিছু সফটওয়্যার ভারীও হয়।)
● “মনোপলি” টার্মটির সাথে হয়তো অনেকেই পরিচিত। এর মানে বোঝায়, একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। ভাবুন তো, যদি আমরা মাত্র কয়েকটি কোম্পানির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে যাই, তাহলে কী হতে পারে? ফেসবুকের সার্ভার ডাউন হওয়ার কারণে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল—এটাই তার বাস্তব উদাহরণ! এই নির্ভরশীলতা কমানোর অন্যতম উপায় হলো ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ব্যবহার করা, যেখানে
কোনো একক প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করতে হয় না।
● ওপেন সোর্স সফটওয়্যারের কোড সবার কাছে উন্মুক্ত থাকার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন ডেভেলপার বাগ ও সিকিউরিটি ইস্যু খুঁজে বের করতে সাহায্য করতে পারে। এর ফলে,
দ্রুত বাগ ফিক্স এবং সিকিউরিটি আপডেট পাওয়া যায়।
● বর্তমান সময়ে তথ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ক্লোজড সোর্স সফটওয়্যারগুলোর ক্ষেত্রে সিস্টেমে কোনো ত্রুটি থাকলে তা কোম্পানি নিজ থেকে দেখতে না পেলে এবং নিজ থেকে সমাধান না করলে কিছু করার থাকে না। এদিকে ওপেন সোর্স সফটওয়্যারগুলোর সবকিছু উন্মুক্ত থাকায় এর কোনো ত্রুটি বা বাগ যে কেউই বের করে তা ধরিয়ে দিতে পারে অথবা নিজেই সমাধান করে দিতে পারে! এছাড়া, অনেক ক্ষেত্রে ক্লাউড-ভিত্তিক সফটওয়্যারগুলোর সার্ভার সাইড উন্মুক্ত থাকে। যার ফলে,
নিজের সার্ভারে তথ্য হোস্ট করে শতভাগ নিশ্চিন্ত থাকা যায়। (যেমনঃ বিটওয়ার্ডেনে রাখা পাসওয়ার্ড নিজের সার্ভারে হোস্ট করা সম্ভব।)
●
এছাড়াও একটা অনেক বড় সুবিধা হলো, কোনো সফটওয়্যার যদি মূল ডেভেলপার আপডেট করা বাদ দিয়েও দেয়, তবুও কেউ না কেউ সেটির আপডেটের হাল ধরতে পারে। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে সুবিধা পাওয়া যায়। (যেমনঃ
Tubelar অ্যাপটির আপডেট এক প্রকার যখন বন্ধ হয়েছিলো, তখন অন্য এক ডেভেলপার একই সোর্স কোড ব্যবহার করে
LastPipeBender ডেভেলপ করে।)
●
সফটওয়্যারগুলো উন্মুক্ত থাকায় তা যে কেউ চাইলে কাস্টমাইজ করে ব্যবহার করতে পারবে। যেমন ধরুন, আমি যে কিবোর্ড ব্যবহার করি, তার স্পেস বাটনটা আমার কাছে ছোট লাগে। চাইলে সেটা এডিট করে বড় বা নিজের প্রয়োজনমতো বাড়িয়ে-কমিয়ে নিতে পারবো। এটা যারা করতে পারে, তারা জানে কতটা হেল্পফুল!
অসুবিধা
● যেসব প্রজেক্ট বা সফটওয়্যারের পেছনে কোনো আর্নিং সোর্স নেই বা ব্যাকগ্রাউন্ডে কোম্পানি নেই, সেই সব সফটওয়্যারে সাধারণত লম্বা সময় রানিং থাকতে পারে না। এক সময় গিয়ে ডেথ প্রজেক্টে পরিণত হয়। কিন্তু, যারা বিভিন্ন পেইড প্ল্যান, সাবস্ক্রিপশন মডেল রাখে, তারা এই দিকে এগিয়ে থাকে। (যেমনঃ Proton, Bitwarden)
● অনেক ক্ষেত্রে এসব সফটওয়্যারে বেসিক ফিচারের ঘাটতি দেখা যায়। যেমনঃ Gramophone অডিও প্লেয়ার একটা প্লেয়ার হিসেবে অনেক ভালো। মোটামুটি যেকোনো অডিও প্লেয়ারে সেই অ্যাপ থেকে সরাসরি অডিও ফাইল ডিলিট করা যায়। মজার বিষয়, গ্রামোফোনে করা যায় না! এরকম কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা কখনও কখনও দেখা যায়। তবে এর মানে এই না যে, সব সফটওয়্যারে ইস্যু থাকবেই।
● কিছু কিছু সফটওয়্যারের UI যেমন সহজ, সুন্দর, সাবলীল হয়, তেমনি অনেক সফটওয়্যারেরগুলো জটিল হয়। অনেক সফটওয়্যারের এই যুগে এসেও ডিজাইন আপডেট করে না। যার ফলে সেগুলো দেখতে যাচ্ছেতাই লাগে।
● আবার কিছু কিছু সফটওয়্যার ব্যবহার করার আগে সেগুলো কিভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা শিখতে হয়। সে কারণে অনেকে ব্যবহার করতেই চায় না।
সবথেকে সহজে ফ্রি ও ওপেন সোর্স সফটওয়্যার খুঁজে পাওয়ার উপায়
এখন আসি শেষ পয়েন্টে। সবথেকে সহজে কীভাবে ফ্রি ও ওপেন সোর্স সফটওয়্যার পাবেন।
অনেক ওপেন সোর্স সফটওয়্যার প্লে স্টোর, অ্যাপ স্টোর বা মাইক্রোসফট স্টোরে পাওয়া যায়। তবে, এদের একটাও ডেডিকেটেডভাবে ওপেন সোর্স সফটওয়্যার স্টোর নয়।
মোবাইলের জন্যে ওপেন সোর্স সফটওয়্যার পাওয়ার সবথেকে সহজ মাধ্যম F-Droid, IzzyOnDroid ইত্যাদি। তবে এদের নিজস্ব অ্যাপ অতটা ইউজার ফ্রেন্ডলি না। এক্ষেত্রে
Droid-ify,
Neo Store এর মতো ক্লায়েন্ট ইউজ করতে পারেন। এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ প্লে স্টোর বা অ্যাপ স্টোরের মতো করে অ্যাপ ইনস্টল বা আনইনস্টল করতে পারবেন।
এখন কেউ কেউ বলবে, ভাই
GitHub,
GitLab কেন বললাম না? কারণ, এগুলো কোড লাইব্রেরি, অ্যাপ লাইব্রেরি না। তবে, যারা কম্পিউটারের জন্যে সফটওয়্যার খুঁজবে, তাদের জন্যে GitHub বা GitLab টাইপের প্ল্যাটফর্মের বিকল্প নেই।
এর বাইরে, সফটওয়্যারগুলোর অফিশিয়াল ওয়েবসাইটেও অনেক সময় সব ধরনের বিল্ড প্রোভাইড করা হয়।
এছাড়া, ওপেন সোর্স সফটওয়্যার পাওয়ার আর এক সহজ উপায় হলো আমাদের নিজেদের ফ্রি ও ওপেন সোর্স লাইব্রেরি
MNR FOSS । এখানে আমি মোবাইল ও কম্পিউটার, উভয়েরই জন্যে সফটওয়্যার সাজিয়ে রেখেছি। আপনার প্রয়োজনীয় টাইপ অনুসারে সার্চ করেও সফটওয়্যারগুলো পেয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ।
আজ এই পর্যন্ত। কোনো বিষয়ে প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় কমেন্ট করতে পারেন। জাযাকাল্লাহু খাইরান।
Written by
Naimur Rahaman
Muslim | Love to Learn, Read, Write | Dreamer of Change | Tech Enthusiast